Friday, April 15, 2011

হাসি কান্নার ব্যতিক্রমী ঈদ

গত বছরের কুরবানীর ঈদ একটু ব্যতিক্রমই কেটেছিল। তার আগেরটাও আরো ব্যতিক্রমী। সেইবার ঠিকই বুঝতে পারছিলাম-- ঐ ঈদের পর আর বাংলাদেশে কয়েকটি ঈদ করতে পারব না। বিদেশে থাকা বাংলাদেশীদের সাক্ষাৎকার টিভিতে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম কিভাবে কাটে আপনজন ছাড়া ভিন্নদেশী ঈদগুলো.......

ঈদের দিন খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠতে হল। গোসল, সেভ করে আগের দিনের রান্না করা সেমাই খেয়ে রওনা দিলাম ঈদগাহে। ঈদগাহে সবার সাথে দেখা হল। বাহিরের তাপমাত্রা মাইনাস। সুতরাং, অনেক কাপড় চোপড় নিজের উপর চাপিয়ে ঈদের নামাযে আসা। নামায শেষে সবার সাথে গেলাম আনিস ভাই এর বাসায়। সেইখানে প্রথমে মিস্টি আর তারপরের খাবারটা ছিল অসাধারণ। খেতে খেতে একেবারে গলা পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল।

আমাদের সাথে একজন নতুন মেহমান ছিল। প্রথমে আমি খেয়াল করিনি। পরে দেখি একজন সুইডিশ নওমুসলিম । আমাদের সাথে এক সাথে নামায পড়ে আনিস ভাইয়ের বাসায় এসেছেন দাওয়াত খেতে। নও মুসলিম নিয়ে আমাদের এক্সাইটমেন্ট অন্যরকম হওয়ারই কথা।সৈকত ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে ও গল্প করছিলেন। আমিও টোকা দিয়ে দেখলাম। কি বলে ও। প্রথমেই জি্জ্ঞাসা করলাম, কেমন লাগছে ঈদ?? হুম, ভালই লাগছে। আমাদের সাথে এই ভাবে ভরপুর্তি খেয়ে ও খুবই আনন্দিত। এত গুলো মানুষের সাথে ঈদ এর আনন্দ ভাগাভাগি করতে তার খুবই ভাল লাগছে। তারপরই জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় পড়াশুনা করছে?? সে পড়ছে স্টোকহোম ইউনিভার্সিটিতে এনথ্রোপিলজিতে। কিভাবে সে ইসলামে আসল জিজ্ঞাসা করাতে সে বলছিল--- আমি আগে থেকে গড এ ভিলিভ করতাম। তবে কোন ধর্ম গ্রন্থই পুওর মনে হত না। আমি সব সময় মেডিটেশান করতাম। জানতে চেষ্টা করতাম আসল গড এর অস্তিত্ব। এর মধ্যেই আমার সাথে পরিচয় হল মুসলিম এক মেয়ের। মেয়েটি প্রাকটিক্যাল মুসলিম ছিল না। তার কাছ থেকে কিছু কিছু বিষয়ে জানতে চেষ্টা করতাম। আমি তার কাছ থেকে জানতে পারলাম আবরাহাম, ইসাক ও যেকব এরা সবাই ইসলামের নবী। তাদেরকে ইসলাম স্বীকৃতি দিয়েছে। তারপর আমি মেয়েটির ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু বই নিয়ে পড়াশুনা শুরু করি। নয় মাস আগে আমি ইসলাম ধর্মে গ্রহণ করি।
তার কথাগুলো শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, মানুষ সত্যকে জানার জন্য আগ্রহী হলে আল্লাহ কিভাবে হেদায়াত দিতে পারেন। সে পুরা কোরআন শরীফ শেষ করেছে, ইসলামের বেসিকগুলো শেখার চেষ্টা করছে। আর আমার কোরআন তো দুরের কথা ইসলামের স্বাভাবিক আচরণগুলোও পালন করি না। সে ইসলামকে জানার জন্য অনেক কষ্ট করছে, নিজের পড়াশুনা বাদ দিয়ে শুধু ইসলামকে জানার জন্য আলাদা কোর্স করছে। আর আমরা ইসলামী বই পু্স্তক তো দুরের কথা নিয়মিত কোরআনই পড়ি না। আমাদের চরিত্র দেখলে মানুষ ইসলামের দিকে আসতে চায় না। আমাদের দেখে কত লোক যে ইসলাম থেকে দুরে সরে গেছে আল্লাহই ভাল জানেন। তার কথাগুলো শুনার পর আত্মসমালোচনা হচ্ছিল। হায়রে, আমরা কতটুকু ভাল মুসলিম সেটা আমরা ভাল করেই জানি।

আনিস ভাইয়ের বাসা থেকে বের হয়ে আরেকটা বাসায় যাব। সেই ভাইয়ার বাসায় গিয়ে ঘটল আরেক ঘটনা। ভাইয়াকে ফোন করাতে ওনি বললেন ওনার আপার ছেলে মারা গেছেন দুইদিন আগে। তাই মন খুব খারাপ। ওনি আরেক বাসায় আছেন । ওই বাসায়ই দেখা করতে হবে। ঠিক আছে আমার বন্ধু মিজানকে নিয়ে গেলাম ভাইয়ার সাথে দেখা করতে। মৃত্যু বাড়িতে ঈদের আনন্দ আর কতটুকু থাকতে পারে? ভাইয়া আমাদের আপার কাছে নিয়ে গেলেন। আপার ছেলে দুই দিন আগে সাত তলার বেলকনি থেকে পড়ে মারা গেছে। ২০ বছরের ছেলেটি কম্পিউটারে কাজ করছিল, ওনি টেলিফোন এ ভিজি ছিলেন। এই অবস্থায় ছেলেটি ব্যালকুনিতে যায়। আপা কিছুক্ষন পরে ছেলেটিকে খুজতে গিয়ে কোথাও খুজে পাননি। ওর এক বন্ধুকে ফোন দেন। সেও জানায় তার ওখানে যায়নি। তার বন্ধুটি নিচে গিয়ে দেখে ২০ বছরের ছেলেটি নিচে পরে আছে। হঠাৎ করে কোন মানুষ উধাও হয়ে গেলে যেমন লাগার কথা সেইরকম লাগছিল আমাদের কাছে। মায়ের নাড়ি ছেড়া ধন ছেলেটি তার চোখের সামনে উধাও হয়ে গেল। আপা বার বারই বলছিলেন, “ আমাদের এত ভাল ছেলেটির কিভাবে এমন হল? ও আমার খুব অনুগত ছিল। সব সময় আমার কাছাকাছি থাকত। আমি বিশ্বাস করি না ও মারা গেছে। ও আসবে, আমি জানলা দিয়ে চেয়ে আছি ও আসবে। ও আসলে আমি ওকে জড়িয়ে ধরব।“ সন্ত্বনা দিব কি, নিজেরই কান্না পাচ্ছিল। এত কম বয়সেও মানুষ মারা যায়?? আপাকে ঔষধ খাওয়ানো হল। তিনি বলছিলেন, আমি তো অসুস্থ না আমাকে ঔষুধ খাওয়াচ্ছ কেন?? জানি না, আপুটা কবে স্বাভাবিক হতে পারবেন? তার আগের বাসা চেইঞ্জ করা হচ্ছে। আপাকে আর আগের বাসায় উঠানো হবে না। তার আত্মীয়স্বজনরা এমেরিকা,ইংল্যান্ড থেকে আসছেন। ছেলেটির বাবা এখন বাংলাদেশে আছেন। তিনিও ফ্লাইটে উঠেছেন। এত বড় শোক এর খবর পাওয়ার পর কার মন ভাল থাকে বলুন।

ঈদের দিন সকালে প্রেজেন্টেশান ছিল। সেটা চেইঞ্জ করা হয়েছিল প্রফেসরকে ম্যানেজ করে। সেই প্রফেসর ক্লাসের শুরুতে জানতে চাইলেন আবরাহাম এর কে ছিলেন? আমাদের কি ধরনের ফ্যাস্টিবল এইটা? আমাদের একজন গিয়ে মুল বিষয়টা বলল। সন্ধ্যায় বাসায় আসলাম। এর পর গেটটুগেদার এর প্রস্তুতি । ১৫ জনের মত মানুষ আসবে। সবাই কিছু না কিছু নিয়ে আসবে রান্না করে।আমি আর আমার রুমমেট এর ভাগে পড়েছে মুরগি। আমরা আগের দিন রান্না করে রেখেছি। আরেকজনের দায়িত্ব সবজি রান্না করা। সেই রান্নাতে তাকে সহায়তা করলাম। সবাই কিছু কিছু জিনিস নিয়ে গেটটুগেদার এ আসল। টেবিলে সব খাবার রেখে ফটোসেশান করা হল। মজার মজার গল্প আর বিশাল খাবার লিস্ট থেকে খেতে খেতে ১২ টা বাজল। বাসায় এসে নামাজটা পড়ে ঘুমিয়ে গেলাম। এইভাবেই কাটল আমার সুইডেনের শেষ ঈদ.......

No comments: